লেবুর উপকারিতা: আমরা সাধারণত খাবারের স্বাদ বাড়াতে এবং গরমের দিনে শরবত তৈরি করতে লেবু ব্যবহার করি। কিন্তু এর উপকারিতা এখানেই শেষ না। লেবুতে আছে ভিটামিন সি এবং খনিজ উপাদান যা আমাদের হৃদযন্ত্রের ধড়ফড়ানি কমানো থেকে ফুসফুসকে ঠিকভাবে কাজ করতে সাহায্য করে। আর সকাল সকাল লেবু পানি পান করা আরও ভালো ।লেবু প্রাচীন কাল থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। লেবুর উত্পত্তি এশিয়াতে হয়েছিল এবং লেবু ভারতের আসাম ও চীনে প্রথম ব্যবহৃত হয়েছিল। বেশিরভাগ লোক জলে মিশ্রিত লেবুর রস খান। ভারতে মহিলারা কাপড়ের দাগ দূর করতে লেবু ব্যবহার করেন। বিজ্ঞানীদের মতে, লেবু দীর্ঘদিন ধরে ঔষুধ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়।
লেবুতে কী কী পুষ্টি থাকে?
লেবুতে ভিটামিন এ, ভিটামিন বি 6, ভিটামিন সি, ভিটামিন ই, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়াম, আয়রন, ফসফরাস, দস্তা, ফোলেট, তামা, প্যানটোথেনিক অ্যাসিড, নিয়াসিন থায়ামিন এবং আরও অনেক প্রোটিন রয়েছে। এই পুষ্টিগুলি স্বাস্থ্যের জন্য খুব উপকারী।
লেবুর উপকারিতা:
১) ওজন কমানোর জন্য: – শরীরের ওজন কমাতে গরম পানিতে লেবুর রস এবং মধু মিশিয়ে প্রতিদিন খেয়ে নিন। ওজন কমাতে প্রতিদিন অনেকেই সকালে খালি পেটে পান করেন এই পানীয়। লেবুতে রয়েছে ভিটামিন সি, যা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে, আর মধুতে রয়েছে অ্যান্টিব্যাক্টেরিয়াল এফেক্ট, যা শরীরের জন্য উপকার। বলা হয়, লেবু, মধু একসঙ্গে হালকা গরম পানি দিয়ে খেলে বিপাক (মেটাবলিজম) সক্রিয় হয়, যা ওজন কমাতে সাহায্য করে। আসলে হালকা গরম পানি মূলত এ কাজটি করে থাকে। আর লেবুর পেকটিন অনেকক্ষণ ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে, তাই ওজন কমে।
২)স্ট্রোকের ঝুঁকি হ্রাস করে: –
৭০০০০ মহিলাদের উপর ১৪ বছরের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে যারা সবথেকে বেশি সাইট্রাস ফল খেয়েছেন তাদের মধ্যে ইস্কেমিক স্ট্রোকের ঝুঁকি ১৯ শতাংশ কম ছিল, ইসকেমিক স্ট্রোক সবচেয়ে সাধারণ ধরণের স্ট্রোক। যখন রক্ত জমাট বাঁধা মস্তিস্কে রক্তের প্রবাহকে বাধা দেয় তখন এটি হতে পারে।২০১৯ সালে আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে যে দীর্ঘমেয়াদী, ফ্লেভোনয়েডযুক্ত খাবারের নিয়মিত ব্যবহার ক্যান্সার এবং কার্ডিওভাসকুলার রোগ থেকে রক্ষা করতে পারে। তবে সমীক্ষায় ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, যে ব্যক্তিরা প্রচুর ধূমপান করেন বা মদ পান করেন তাদের উপকারের সম্ভাবনা কম।
৩) হাঁপানি রোধে লেবুর উপকারিতা : –
যদি আপনি হাঁপানি আক্রান্ত মানুষ হয়ে থাকেন এবং আপনি চাচ্ছেন বিষয়টা যতটুকু সম্ভব নিয়ন্ত্রণে রাখতে তবে অবশ্যই আপনার বেশি পরিমাণে ভিটামিন সি এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান বেশি বেশি সেবন করা উচিত। যারা শ্বাসকষ্টে অথবা হাইপারসেনসিটিভিটিতে ভুগছেন তাদের জন্য ভিটামিন সি একটি কার্যকরী পুষ্টি উপাদান।আর লেবু হচ্ছে উচ্চ ভিটামিন সি যুক্ত ফল।
৪) উচ্চ রক্তচাপ কমায়: –
লেবুতে রয়েছে উচ্চমাত্রার ভিটামিন সি আর পটাশিয়াম এবং লেবু সাইট্রাস পরিবারভুক্ত। এতে আরো কিছু প্রয়োজনীয় উপাদান রয়েছে যা শরীরের উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে কাজ করে এবং লেবুতে বিদ্যমান পটাশিয়াম হৃদপিন্ডের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারে।
৫)দাঁত ও মাড়ির রোগে উপকারী: –
বাতাবি লেবু ব্যবহার করা হয় দাঁতের যত্নে। বাতাবি লেবুর রস মাড়ির নানা সমস্যার জন্যও উপকারী।
৬)গলার সংক্রমণ রোধ করে: –
লেবুর রসে আছে ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী এক অনন্য বৈশিষ্ট্য, যার ফলে গলাব্যথা, মুখের ঘা আর টনসিলের সংক্রমণ রোধে সাহায্য করে লেবু।
৭)পাকস্থলীকে সুস্থ রাখে: –
পেটের যেকোনো সমস্যা যেমন ডায়রিয়া, বদহজম, কোষ্ঠকাঠিন্য আমাদেরকে অনেক অসুস্থ করে ফেলে। শরীরের অস্বস্তি ভাব কমাতে একটি লেবু অল্প কিছু লবণ এর সাথে মিশিয়ে খেলে আরাম বোধ হতে পারে।
৮)হৃদ রোগের জন্য লেবুর উপকারিতা: –
বাতাবি লেবুতে আছে যথেষ্ট পরিমান পটাশিয়াম, ভিটামিন-সি। ফলে বাতাবিলেবু রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। নিয়মিত রক্তচাপ হৃদরোগের জন্য উপকারী।বাতাবি লেবু রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে দেয়।
৯) মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে সহায়তা করে: –
লেবুতে ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী এলিমেন্টস থাকায় তা মাড়ির ব্যাথা, দাতের সমস্যা, মুখের দুর্গন্ধ অনেকটাই দূর করে।
১০)মানসিক চাপ কমায় : –
লেবুর রসে ভিটামিন সি রয়েছে যা মানুষের মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা নিয়ন্ত্রনে সহায়তা করে। মানসিক বিষণ্নতায় শরীরবৃত্তীয় কারণে ভিটামিন সি এর ঘাটতি দেখা দেয় এবং লেবুর রস সেটি পূরণ করে নিমিষেই। ফলে মানসিক চাপ অনেকটাই কমে যায়।
১১)রক্তশুন্যতা প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে: –
আমাদের দৈনন্দিন খাবারে খাবার লোহা বা আয়রন থাকে, যা শোষণের জন্য ভিটামিন সি এর প্রয়োজন হয় এবং খাবারের সঙ্গে লেবু সেবন করলে তা দ্রুত খাদ্য পরিপাকে সহায়তা করে এবং শরীরে রক্তশূন্যতা বা এনিমিয়া প্রতিরোধ করে থাকে।
পেটের গ্যাসের সমস্যা কাটিয়ে উঠতে: – পেটের গ্যাস বা বদহজমের মতো সমস্যা দূর করতে লেবুর জল খুব কার্যকর।
১২)ক্যান্সার দূর করে: –
আমরা সবাই জানি ভিটামিন সি শরীরের নানা রোগ প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে। এবং গবেষণায় দেখা গেছে লেবুতে থাকা ভিটামিন সি এবং পুষ্টি উপাদান সমূহ ক্যান্সারের ক্ষতিকারক কোষ ধ্বংস করে যা ক্যানসার প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে থাকে।
১৩) হার্টকে স্বাস্থ্যকর করে তোলে: –
লেবু সহ সাইট্রাস ফলগুলিতে প্রয়োজনীয় ফ্ল্যাভোনয়েড থাকে যা এথেরোস্ক্লেরোসিসের চিকিৎসায় সহায়তা করে। এই উপাদানগুলি দেহে প্রদাহজনক প্রতিক্রিয়াগুলি কমিয়ে কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি কমায় ।
১৪)ঠোঁটের সৌন্দর্য বর্ধনে: –
আমাদের ত্বকের মতো ঠোঁটে ও ডেডসেল জমে।এই ডেডসেল রিমুভ এর জন্য লেবুর ছোট একটি টুকরো কেটে হালকা ভাবে ঠোঁটে ঠলে পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে নিন। এরপর ঠোটে ১০ মিনিট এর মতো মধুর লেপ লাগিয়ে রাখুন। এরকম সপ্তাহে ১-২দিন করে করুন। ঠোঁট গোলাপি রাখতে এই পদ্ধতি অনেক ভালো কার্যকরী হবে।
১৫)কালচে ভাব দূর করতে: –
অনেক সময় আমাদের ঘাড়, গলায় বা শরীরের নানা জায়গায় কালো দাগ পড়ে যায়। অনেক সময় শরীরে মরা চামড়া ও জমতে থাকে। সেসব জায়গায় লেবু দিয়ে ঘসে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সে স্থান ধুয়ে মধু মিশিয়ে কিছুক্ষণ রেখে পরিষ্কার পানি দিয়ে পুনরায় ধুয়ে নিন। এই প্রক্রিয়ায় সপ্তাহে চার থেকে পাঁচ বার করলে দারুণ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।
১৬) চুলে লেবুর ব্যবহার : –
অনেকের চুলে খুশকি হয়, স্কাল্পে ক্ষত হয়, স্কাল্পে রেগুলার লেবু দিয়ে মাসাজ করে তারপর শ্যাম্পু করলে খুশকি দূর হয়। এবং চুলে কোনো ক্ষত থাকলে তাও দূরীভূত হয়।চুলে কোনো ক্ষত বা ফাংগাল সম্পর্কিত সমস্যা হয়না।
১৭) নখ সুন্দর রাখতে সহায়তা করে: –
এক টুকরো ছোট লেবুর টুকরো দিয়ে ঘসে নখে থাকা ময়লা এবং মরা চামড়া দূর করে নখ কে একদম পরিষ্কার এবং গোলাপি বর্নের করা সম্ভব।
১৮)শরীরে পানির ঘাটতি মেটাতে: –
শরীরে যতটা পানির প্রয়োজন তার ঘাটতি মেটাতে সাহায্য করে লেবু। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মহিলার শরীরে প্রতিদিন প্রয়োজন ৯১ আউন্স পানি, একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের শরীরে প্রয়োজন ১২৫ আউন্স পানি। তবে অনেক সময়ই সেই পরিমাণ পানি খাওয়া হয় না। লেবু খেলে সেই ঘাটতি পূরণ হয়।
লেবুর খোসা খাওয়ার উপকারিতা
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে লেবুতে বিদ্যমান ভিটামিন এর চেয়ে প্রায় ৫-১০ গুন বেশি পরিমাণ ভিটামিন থাকে লেবুর খোসায়।লেবুর খোসায় রয়েছে বেটা-ক্যারোটিন, পোলেট, ক্যালসিয়াম ম্যাগনেসিয়াম এবং পটাশিয়াম যা আমাদের শরীরের জন্য অনেক উপকারী।
. লেবুর খোসা ক্যান্সার কোষের জীবাণু ধংস করে।
.লেবুর খোসা শরীরে সাইট্রিক এসিড এর পরিমাণ বৃদ্ধি করে ফলে কিডনিতে পাথর হবার সম্ভাবনা একদম ক্ষীণ হয়ে যায়।
.লেবুর খোসা নিয়মিত খেলে ব্যাকটেরিয়া এবং ফাংগাল ইনফেকশন থেকে বাচা যায়।
.লেবুর খোসা নিয়মিত সেবনে শরীরে ব্লাড সার্কুলেশন অনেক বেড়ে যায় এবং শরীরের প্রতিটি জায়গায় অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত প্রবাহ হয়।যার ফলে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
.লেবুর খোসায় বিদ্যমান পেকটিন নামক উপাদান মানুষের শরীরের অতিরিক্ত চর্বি জড়াতে সাহায্য করে যা ওজন কমার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।.
.নিয়মিত লেবুর খোসা সেবনের ফলে শরীরে এন্টি অক্সিডেন্টের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং টক্সিন পদার্থ পাকস্থলী থেকে সহজে বের হয়ে যেতে পারে যা পাকস্থলীর কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
লেবুর খোসায় বিদ্যমান অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ত্বক উজ্জল করতে এবং ত্বকে বিদ্যমান বলিরেখা দূর করতে সহায়তা করে।
গৃহস্থালি কাজে লেবুর উপকারিতাঃ
ভাত রান্নার সময় কয়েক ফোঁটা লেবুর রস দিলেই ভাত হবে ঝরঝরা।অনেক সময় ফল কেটে রাখলে সেগুলো কিছু সময় পর কালো হয়ে যায়। এ সমস্যা সমাধানে ফল কেটে তাতে কয়েক ফোঁটা লেবুর রস লাগিয়ে রাখুন। এটি অ্যাসিডিক হওয়ার কারণে তা ফলের অক্সিডেশনের পদ্ধতি আটকে দেয় এবং কাটা ফলকেও রাখে সতেজ। আলুর ক্ষেত্রেও এ সমস্যার সমাধান মেলে।অনেক সময় ডিম সিদ্ধ করতে দিলেই তার খোসা ফেটে যায়। এ সমস্যা সমাধানে পানিতে ডিম দেওয়ার আগে ডিমের গায়ে একটু গায়ে লেবুর রস মাখিয়ে নিন। ব্যাস, এতেই মিলবে সমাধান।বেশি লবণ খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। অনেকে খাবারে স্বাদ না পেলে সমাধান হিসেবে বেছে নেন লবণ। কিন্তু এর পরিবর্তে লেবুর রস ব্যবহার করেই পেতে পারেন স্বাস্থ্যকর সমাধান। খাবারের স্বাদ বাড়াতে এর মতো স্বাস্থ্যকর সমাধান আর নেই।
কোলেস্টেরল এর মাত্রা কমায়
রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে এই লেবু। এটি শরীরের উপকারী কোলেস্টেরল মাত্রা বাড়িয়ে দেয় এবং ক্ষতিকর কোলেস্টেরলকে নিয়ন্ত্রণে রাখে।
দাদ ও চুলকানির জন্য: – দাদ বা চুলকানির সমস্যা দূর করতে লেবুর রসে লেবুর রস লাগান। দাদ এবং চুলকানির সমস্যা থেকে মুক্তি পাবেন। লেবু ত্বক সম্পর্কিত সমস্ত সমস্যার জন্য উপকারী।
ব্রন দূর করতে লেবু
সরাসরি লেবু মুখের ত্বকে ব্যবহার করা উচিত নয়। এটি অনেক ক্ষারীয় পদার্থ যার দরুন অনেকের কিছু বিশেষ সাইডএফেক্ট হতে পারে। কিন্তু ব্রণ দূর করতে এই লেবুর রস অনেক ভালো কাজ করে। লেবুর ১-২ ফোটা রসের সঙ্গে সামান্য মধু মিশিয়ে মুখে যেসব জায়গায় ব্রণ রয়েছে সেই জায়গাগুলোতে লাগিয়ে ১৫ মিনিট অপেক্ষা করুন এবং প্যাকটি লাগানোর সময় ব্রনে আঙ্গুল দিয়ে ঘষবেন না বরং আলতো করে প্যাকটি সেই নির্দিষ্ট স্থানে লাগিয়ে দিবেন। ১৫ মিনিট পর পরিষ্কার পানি দিয়ে তা ধুয়ে নিন। এই প্যাক আপনার ত্বকে বিদ্যমান ব্রন কে ছোট করবে এবং ব্রণের দাগ হতে দিবেনা।